মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইসরায়েলকে দীর্ঘদিন ধরেই একটি শক্তিশালী সামরিক ও কৌশলগত রাষ্ট্র হিসেবে দেখা হয়েছে। একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ চালানোর সক্ষমতা, আধুনিক প্রযুক্তি এবং পশ্চিমা বিশ্বের দৃঢ় সমর্থন দেশটিকে একটি প্রভাবশালী অবস্থানে রেখেছিল। তবে সাম্প্রতিক বাস্তবতা ইঙ্গিত দিচ্ছে, এই শক্ত অবস্থানের ভেতরে বড় ধরনের ফাটল তৈরি হচ্ছে।
বাইরে থেকে ইসরায়েল এখনো শক্তিশালী মনে হলেও, ভেতরের পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। সামরিক লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থতা, আন্তর্জাতিক সমর্থনের ক্ষয়, কূটনৈতিক চাপ এবং অভ্যন্তরীণ সামাজিক বিভাজন দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলছে।
গাজা যুদ্ধ: প্রত্যাশা ও বাস্তবতার ফারাক
গাজায় দীর্ঘ সময় ধরে চালানো সামরিক অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল হামাসকে সম্পূর্ণভাবে দুর্বল করা এবং জিম্মিদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু বাস্তবে এই দুটি লক্ষ্যই পূরণ হয়নি বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
যুদ্ধের সময় ইসরায়েল দাবি করেছিল, সামরিক শক্তির মাধ্যমে তারা পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে। কিন্তু যুদ্ধ যত দীর্ঘ হয়েছে, ততই স্পষ্ট হয়েছে যে সামরিক অভিযানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। হামাস পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি, বরং সংঘাত নতুন আকার ধারণ করেছে।
একই সঙ্গে জিম্মি ইস্যুতেও প্রত্যাশিত সাফল্য আসেনি। বরং বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, সামরিক হামলায় অনেক জিম্মির জীবন ঝুঁকির মুখে পড়েছে, যা ইসরায়েলি সমাজে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক সমর্থনের ধীরে ধীরে ক্ষয়
এক সময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক দেশ ইসরায়েলের প্রতি প্রায় নিঃশর্ত সমর্থন জানাত। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই অবস্থান আর আগের মতো দৃঢ় নেই।
গাজায় ব্যাপক মানবিক সংকট, বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা এবং অবকাঠামোগত ধ্বংস আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ তৈরি করেছে। এর ফলে পশ্চিমা দেশগুলো প্রকাশ্যে না হলেও নীরবে ইসরায়েলের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।
একটি আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গাজাকে ভবিষ্যতে ইসরায়েলের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখার চিন্তাভাবনাও সামনে আসছে। এই প্রক্রিয়ায় কাতার, মিসর, সৌদি আরব ও তুরস্কের মতো দেশগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
নেতানিয়াহুর কৌশল: যুদ্ধ নয়, হুমকির রাজনীতি?
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে শক্ত অবস্থানের কথা বললেও বাস্তবে তার কৌশলে পরিবর্তনের আভাস মিলছে। বিশ্লেষকদের মতে, সরাসরি যুদ্ধের পরিবর্তে যুদ্ধের সম্ভাবনা বজায় রাখাই এখন তার জন্য বেশি কার্যকর।
কারণ দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত ইসরায়েলের অর্থনীতি, কূটনীতি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর বড় চাপ তৈরি করছে। যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক মূল্য এখন অনেক বেশি।
এই বাস্তবতায় ইসরায়েল হয়তো এমন এক কৌশল বেছে নিচ্ছে, যেখানে সংঘাত পুরোপুরি বন্ধ না হলেও নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় রাখা হবে।
সামরিক শক্তির সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হচ্ছে
সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন ও ইরান—এই সব অঞ্চলে ইসরায়েলের সামরিক তৎপরতা দীর্ঘদিন ধরে চলেছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন।
বর্তমানে সেই সহযোগিতার জায়গাটিও সংকুচিত হচ্ছে। ফলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বড় আকারের সামরিক বিস্তারের বদলে সীমিত ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক অভিযানে মনোযোগ দিচ্ছে।
এটি ইঙ্গিত দেয়, সামরিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও কৌশলগত স্বাধীনতা আগের মতো নেই।
ইসরায়েলি সমাজে গভীর বিভাজন
সবচেয়ে বড় সংকেতটি আসছে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ সমাজ থেকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটির ভেতরে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভাজন স্পষ্ট হয়েছে।
সামরিক বাহিনীর মধ্যেও নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে শৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনা ইসরায়েলি সমাজে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
একদিকে সরকার ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রতি আনুগত্যের কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে সেই একই সরকারের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদের ইতিহাস রয়েছে—এই দ্বন্দ্ব সমাজকে আরও বিভক্ত করছে।
মানবিক ও সামাজিক সংকটের ছায়া
গাজা যুদ্ধের প্রভাব শুধু সীমান্তেই সীমাবদ্ধ নয়। এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ জীবনযাত্রায়ও।
স্বাস্থ্যব্যবস্থা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং জনসেবামূলক খাতে চাপ বাড়ছে। সহিংসতার মানসিক প্রভাব সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। যুদ্ধফেরত সেনাদের মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস দেশটির জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
প্রতিষ্ঠানগত দুর্বলতা ও ভবিষ্যৎ শঙ্কা
বিশ্লেষকেরা বলছেন, একটি রাষ্ট্র শুধু সামরিক শক্তি দিয়ে টিকে থাকে না। শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, কার্যকর প্রশাসন ও সামাজিক ঐক্যও প্রয়োজন।
ইসরায়েলের ক্ষেত্রে এই তিনটি স্তম্ভই এখন চাপের মুখে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ছে, দক্ষ জনবল হারানোর অভিযোগ উঠছে, আর সামাজিক ঐক্য ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে।
এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে ইসরায়েল এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে পারে, যা তারা নিজেরা পরিকল্পনা করেনি।
উপসংহার
ইসরায়েল এখনো একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র, এতে সন্দেহ নেই। তবে শক্তির পাশাপাশি দুর্বলতার দিকগুলোও ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। গাজা যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক চাপ, অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও প্রতিষ্ঠানগত সংকট—সব মিলিয়ে দেশটি একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।
এই সন্ধিক্ষণ থেকে ইসরায়েল কোন পথে যাবে, তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, কূটনৈতিক কৌশল এবং সমাজের ভেতরের ঐক্যের ওপর। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার—আগের মতো প্রশ্নহীন শক্ত অবস্থান আর নেই।








Leave a Reply