অ্যাডিলেড টেস্টের তৃতীয় দিনের খেলা শেষ হতেই নতুন করে আলোচনায় এসেছে একটি প্রশ্ন—অ্যাশেজ সিরিজে সবচেয়ে দ্রুত হারের রেকর্ড কি ভাঙতে যাচ্ছে ইংল্যান্ড? পাঁচ ম্যাচের এই ঐতিহ্যবাহী সিরিজের মাত্র তৃতীয় টেস্ট চলছে, অথচ ফলাফলের দিক থেকে অস্ট্রেলিয়া এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে, যেখানে ইংল্যান্ডের সামনে আশার আলো প্রায় নিভু নিভু।
সিরিজ শুরুর আগে অস্ট্রেলিয়া দলকে নিয়ে নানা সমালোচনা ছিল। বয়সী ক্রিকেটারদের আধিক্যের কারণে অনেকেই দলটিকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘বুড়োদের দল’। কিন্তু মাঠের পারফরম্যান্সে সেই ধারণাকে পুরোপুরি ভুল প্রমাণ করেছে প্যাট কামিন্সের নেতৃত্বাধীন দলটি। তিন টেস্টেই অস্ট্রেলিয়ার আধিপত্য এতটাই স্পষ্ট যে ইংল্যান্ডের জন্য এই সিরিজ যেন এক দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছে।

অ্যাডিলেড টেস্টে অস্ট্রেলিয়া বনাম ইংল্যান্ড ম্যাচে সেঞ্চুরির পর ট্রাভিস হেড
আগের দুই টেস্টেই স্পষ্ট ব্যবধান
চলতি অ্যাশেজের প্রথম দুই টেস্টেই অস্ট্রেলিয়ার দাপট ছিল চোখে পড়ার মতো। পার্থে মাত্র দুই দিনেই ম্যাচ শেষ করে জয় তুলে নেয় স্বাগতিকরা। এরপর ব্রিসবেন টেস্টেও চার দিনের মধ্যে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে সিরিজে ২–০ ব্যবধানে এগিয়ে যায় তারা।
অ্যাডিলেডে এসে সেই ধারাবাহিকতা আরও জোরালোভাবে বজায় রেখেছে অস্ট্রেলিয়া। তৃতীয় দিন শেষে তাদের লিড দাঁড়িয়েছে ৩৫৬ রান, হাতে রয়েছে দ্বিতীয় ইনিংসের আরও ৬ উইকেট। সাধারণ ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণে এমন অবস্থান থেকে ম্যাচ হারার নজির প্রায় নেই বললেই চলে।
অ্যাডিলেডে চতুর্থ ইনিংসের ইতিহাস ইংল্যান্ডের বিপক্ষে
অ্যাডিলেড ওভালে চতুর্থ ইনিংসে বড় রান তাড়া করে জয়ের ইতিহাস ইংল্যান্ডের জন্য মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। এই মাঠে শেষবার ৩০০ রানের বেশি লক্ষ্য তাড়া করে জয় এসেছিল আজ থেকে ১২৩ বছর আগে। সে সময়ও অস্ট্রেলিয়ার হয়েই, ঘরের ছেলে ক্লেম হিলের ব্যাটে সেই ঐতিহাসিক জয় এসেছিল।
এই সিরিজে এখন পর্যন্ত ইংল্যান্ড পাঁচ ইনিংসে মাত্র একবারই ৩০০ রানের গণ্ডি ছুঁতে পেরেছে। এমন বাস্তবতায় অ্যাডিলেড টেস্টে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা প্রায় ক্ষীণ।
দ্রুততম অ্যাশেজ হার: নতুন রেকর্ডের পথে?
তিনটি টেস্ট মিলিয়ে এখন পর্যন্ত মোট ৯ দিনের খেলা হয়েছে। যদি অস্ট্রেলিয়া চতুর্থ দিনের সকালে দ্রুত রান বাড়িয়ে ইনিংস ঘোষণা করে দেয় এবং ইংল্যান্ড ওই দিনই ম্যাচ হেরে বসে, তাহলে চলতি অ্যাশেজ শেষ হবে মাত্র ১০ দিনে।
অস্ট্রেলিয়ায় পাঁচ ম্যাচের অ্যাশেজ সিরিজে দ্রুততম হারের রেকর্ড বর্তমানে ১১ দিনের। সেটি হয়েছিল ২০০২–০৩ মৌসুমে। অ্যাডিলেড টেস্ট যদি চতুর্থ দিনেই শেষ হয়ে যায়, তাহলে সেই রেকর্ড ভেঙে যাবে। আর ম্যাচ পঞ্চম দিন পর্যন্ত গড়ালেও সমান হবে পুরোনো রেকর্ড।
অবশ্য ইতিহাস বলছে, ইংল্যান্ড সফরে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া এর চেয়েও দ্রুত সিরিজ জিতেছে। ১৯২১ সালে ওয়ারউইক আর্মস্ট্রংয়ের নেতৃত্বে মাত্র আট দিনেই ইংল্যান্ডের মাটিতে অ্যাশেজ নিশ্চিত করেছিল অস্ট্রেলিয়া।
স্টোকস–আর্চারের লড়াই: ইংল্যান্ডের একমাত্র আলো
অ্যাডিলেড টেস্টের তৃতীয় দিনে ইংল্যান্ডের জন্য সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক ছিল বেন স্টোকস ও জফরা আর্চারের নবম উইকেট জুটি। দ্বিতীয় দিন শেষে ইংল্যান্ড ৮ উইকেটে ২১৩ রানে থেমে ছিল, পিছিয়ে ছিল ১৫৮ রানে।
তৃতীয় দিনের সকালে এই দুই ব্যাটসম্যান কিছুটা আশা জাগান। ১৮১ বলের জুটিতে তাঁরা যোগ করেন ১০৬ রান। বেন স্টোকস ৮৩ রানে আউট হলেও আর্চার করেন ৫১ রান—টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি।
এই জুটি ইংল্যান্ডের জন্য শুধু ম্যাচে টিকে থাকার লড়াই নয়, ইতিহাসেও জায়গা করে নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে গত ১০১ বছরে ইংল্যান্ডের নবম উইকেটে এটাই সর্বোচ্চ রানের জুটি।
দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং ঝড়
ইংল্যান্ডের একমাত্র সুযোগ ছিল অস্ট্রেলিয়াকে দ্বিতীয় ইনিংসে দ্রুত গুটিয়ে দেওয়া। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে ঠিক তার উল্টোটা। মাত্র ৬৬ ওভারে ৪ উইকেট হারিয়ে ২৭১ রান তুলে ফেলে অস্ট্রেলিয়া।
এই ইনিংসে উজ্জ্বল ছিলেন ট্রাভিস হেড। ১৯৬ বলে অপরাজিত ১৪২ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। অন্য প্রান্তে অ্যালেক্স ক্যারি অপরাজিত ছিলেন ৫২ রানে।
অ্যাডিলেডে টানা চার টেস্টে সেঞ্চুরি করে হেড জায়গা করে নিয়েছেন ক্রিকেট ইতিহাসের বিশেষ এক তালিকায়। এই ভেন্যুতে টানা চার টেস্টে সেঞ্চুরির কীর্তি আছে কেবল মাইকেল ক্লার্ক, স্টিভেন স্মিথ ও ডন ব্র্যাডম্যানের। এবার সেই তালিকায় যোগ হলো ট্রাভিস হেডের নাম।
ইংল্যান্ডের আত্মবিশ্বাস বনাম বাস্তবতা
সংবাদ সম্মেলনে ইংল্যান্ড দলের স্পিন বোলিং কোচ জিতান প্যাটেল আশার কথা শোনানোর চেষ্টা করেন। তাঁর ভাষায়, দল এখনো জয়ের কথাই ভাবছে।
তিনি বলেন, “আমরা সব সময়ই জয়ের চিন্তা নিয়ে মাঠে নামি। সকালে কিছু উইকেট নিতে পারলে চাপটা অস্ট্রেলিয়ার দিকে ফেরানো সম্ভব।”
কত রান তাড়া করলে জয় সম্ভব—এ প্রশ্নে প্যাটেলের উত্তর ছিল বেশ বাস্তববাদী, “সেই জাদুকরি সংখ্যাটা কত, আমরা নিজেরাও জানি না।”
তবে মাঠের পরিস্থিতি এবং ইতিহাস—দুটোই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কথা বলছে।
সংক্ষিপ্ত স্কোরকার্ড
অস্ট্রেলিয়া:
প্রথম ইনিংস ৩৭১
দ্বিতীয় ইনিংস ২৭১/৪
(ট্রাভিস হেড ১৪২*, অ্যালেক্স ক্যারি ৫২*)
ইংল্যান্ড:
প্রথম ইনিংস ২৮৬
(বেন স্টোকস ৮৩, জফরা আর্চার ৫১)
উপসংহার
অ্যাডিলেড টেস্টে যা দেখা যাচ্ছে, তা কেবল একটি ম্যাচের গল্প নয়—এটি পুরো সিরিজের চিত্র। অস্ট্রেলিয়া শুধু দক্ষতায় নয়, মানসিক দিক থেকেও ইংল্যান্ডকে ছাপিয়ে গেছে। ইংল্যান্ড যদি এখান থেকে অলৌকিক কিছু না ঘটাতে পারে, তাহলে চলতি অ্যাশেজ ইতিহাসের দ্রুততম পরাজয়ের তালিকায় জায়গা করে নিতে পারে।
এখন দেখার বিষয়, চতুর্থ দিনেই কি সেই ইতিহাস লেখা হয়ে যাবে, নাকি ইংল্যান্ড অন্তত রেকর্ড ভাঙার লজ্জা কিছুটা হলেও এড়াতে পারবে।









Leave a Reply